ইউটিউবের নতুন নীতিমালা ২০২৫
ইউটিউবের নতুন নীতিমালা ২০২৫, ভিডিও বানানো থেকে আয় সবই কি বদলে যাবে?
ইউটিউব আজ শুধু একটি ভিডিও প্ল্যাটফর্ম নয়, লাখো মানুষের রুটিরুজির হাতিয়ার। একেকজন ক্রিয়েটরের পেছনে কাজ করে একেকটি টিম, পরিবার, এমনকি ছোট ছোট ব্যবসা। কিন্তু এই বিশাল কমিউনিটিকে ম্যানেজ করতে গিয়ে ইউটিউবকে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করতে হয় তাদের নীতিমালা। সম্প্রতি ইউটিউবারদের জন্য একগুচ্ছ নতুন নিয়ম চালু করেছে প্ল্যাটফর্মটি। কিছু নিয়ম ক্রিয়েটরদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে, আবার কিছু নিয়মে চাপা ক্ষোভও দেখা যাচ্ছে ফোরামে-সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রশ্ন হচ্ছে—এই পরিবর্তনগুলো আপনার চ্যানেলকে কতটা প্রভাবিত করবে? ভিডিও কনটেন্ট তৈরি থেকে শুরু করে আয়ের সোর্স, সবকিছুতে কি বড় ধস নামবে? নাকি এসব নিয়ম মেনে চললে আপনার চ্যানেলই হয়ে উঠবে আরো প্রফেশনাল? চলুন, গল্পের মতো করে জেনে নেওয়া যাক পুরো ব্যাপারটা!
১. স্ট্রিক্টার মনিটাইজেশন পলিসি: এবার ভিডিওতে এড দেখানোর আগে "দ্বিগুণ চেক।
ইউটিউবের এডসেন্স প্রোগ্রামে যুক্ত হওয়া মানেই টাকার ছবি দেখা—এমন ভাবনা অনেকের। কিন্তু নতুন নিয়মে মনিটাইজেশন পাওয়া এখন আগের চেয়ে কঠিন। আগে ভিডিও আপলোড করার পর অটোমেটিক এডস চালু হতো, এখন নতুন ক্রিয়েটরদের জন্য প্রথমে একটি ম্যানুয়াল রিভিউ প্রক্রিয়া যোগ করা হয়েছে। ইউটিউবের টিম সরাসরি চেক করবে আপনার কনটেন্ট তাদের গাইডলাইন মেনে চলছে কি না। এই প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগতে পারে ৩০ দিন পর্যন্ত!

কী কী চেক করা হয়?
- ভিডিওতে কপিরাইট-ভায়োলেটিং মিউজিক/ক্লিপ ব্যবহার করা হয়েছে কি না।
- কনটেন্ট কি ইউটিউবের এড ফ্রেন্ডলি গাইডলাইন মেনে তৈরি (যেমন: ভায়োলেন্স, সেনসিটিভ টপিক, অ্যালকোহল-জুয়া সংক্রান্ত কনটেন্ট)।
- ভিডিওর টাইটেল, থাম্বনেইল, ডেসক্রিপশনে ক্লিকবেইট বা মিসলিডিং তথ্য আছে কি না।
ক্রিয়েটরদের প্রতিক্রিয়া:
-সুবিধা: যারা নিয়ম মেনে কনটেন্ট বানান, তাদের ভিডিওতে এড ব্লক হওয়ার ঝুঁকি কমবে।
-অসুবিধা: নতুন চ্যানেলের জন্য আয় শুরু করতে দেরি হবে। অনেক ক্রিয়েটর অভিযোগ করছেন, "৩০ দিন পরেও রিভিউ শেষ হচ্ছে না, এভাবে টাকা ইনকাম করা অসম্ভব!"
টিপস: মনিটাইজেশন চান? তাহলে ভিডিও বানানোর আগেই পড়ে ফেলুন YouTube Partner Program এর আপডেটেড গাইডলাইন। বিশেষ করে, থাম্বনেইলে অ্যাডাল্ট কনটেন্ট বা এক্সাগজারেটেড এক্সপ্রেশন (যেমন: 'SHOCKING!', 'YOU WON'T BELIEVE THIS!') এড়িয়ে চলুন।
২. কপিরাইট ক্লেইমের নতুন নিয়ম: 'ফেয়ার ইউজ' এখন আর 'সেফ জোন' নয়!
মুভি রিভিউ, গানের কভার, বা মেমেস—এই ধরনের কনটেন্ট তৈরি করা ক্রিয়েটরদের জন্য বড় খারাপ খবর দিয়েছে ইউটিউব। আগে 'ফেয়ার ইউজ' (Fair Use) এর আন্ডারে এসব কনটেন্টে এড চালু রাখা যেত, এখন কপিরাইট হোল্ডাররা সহজেই ক্লেইম করতে পারবেন। এমনকি ভিডিওতে ৫-১০ সেকেন্ডের ক্লিপ ব্যবহার করলেও স্ট্রাইক বা মনিটাইজেশন বন্ধ হতে পারে।
কেস স্টাডি:
- **গেমিং চ্যানেল:** গেমের ফুটেজ দেখালে এখন গেম ডেভেলপাররা ক্লেইম করতে পারেন।
- **রিয়্যাকশন ভিডিও:** মুভির দৃশ্য দেখানোর সময় ওরিজিনাল অডিও ট্র্যাক ব্যবহার করলে সমস্যা হতে পারে।
ক্রিয়েটরদের বিকল্প পথ:
1. ইউটিউবের অডিও লাইব্রেরি থেকে রয়্যালটি-ফ্রি মিউজিক ব্যবহার করুন।
2. ক্লিপের বদলে স্ক্রিনশট বা নিজের ভয়েসওভার ব্যবহার করুন।
3. কপিরাইট হোল্ডারদের অনুমতি নিন (যেমন: ইমেইল করে পারমিশন চাওয়া)।
সমালোচনা: ছোট ক্রিয়েটররা বলছেন, "বড় কোম্পানিগুলো এখন যেকোনো ভিডিওকে টার্গেট করছে, এটা তো স্রেঅ্যাবিউজ!" ইউটিউবের জবাব: "আমরা ক্রিয়েটরদের পক্ষেও আপিল করার সুযোগ রাখছি।"
৩. স্পন্সরড কনটেন্টে নতুন বাধ্যবাধকতা: "প্রমোশন" লিখলেই হবে না!
অনেক ইউটিউবারই স্পন্সরশিপ বা অ্যাফিলিয়েট লিংক থেকে আয় করেন। নতুন নিয়মে এই ধরনের কনটেন্টে স্পষ্ট করে বলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু ডেসক্রিপশনে "#Promotion" লিখলে চলবে না—ভিডিওর শুরুতে বা ভয়েসওভারেও উল্লেখ করতে হবে।

যেভাবে প্রকাশ করবেন:
- ভিডিওর প্রথম ৩০ সেকেন্ডে বলুন: "এই ভিডিওটি XYZ কোম্পানির স্পন্সরকৃত।"
- স্ক্রিনে টেক্সট ডিসক্লোজার যোগ করুন (কমপক্ষে ৫ সেকেন্ডের জন্য)।
- অ্যাফিলিয়েট লিংকের ক্ষেত্রে বলুন: "লিংক থেকে কিনলে আমি কমিশন পাব।"
শাস্তি কী?
নিয়ম ভাঙলে প্রথমবার সতর্কতা, দ্বিতীয়বার মনিটাইজেশন বন্ধ, তৃতীয়বার চ্যানেল সাসপেনশন! একজন ফুড ক্রিয়েটর বলেছেন, "আমি একটি চুলার ব্র্যান্ডের রিভিউ করেছিলাম। স্পন্সরশিপ না বলায় স্ট্রাইক পেয়েছি—এখন থেকে আর রিস্ক নেব না।"
৪. চাইল্ড সেফটি এক্সটেন্ডেড: ১৩ বছরের নিচের বাচ্চাদের ভিডিওতে Restrictions.
বাচ্চাদের টার্গেট করে কনটেন্ট বানানো ক্রিয়েটরদের জন্য নতুন সতর্কতা। এখন কোনো ভিডিওতে যদি ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের মুখ দেখা যায়, তাহলে সেগুলোতে এডস চালু করা যাবে না। এমনকি কমেন্ট সেকশনও ডিসেবল করে দিতে হবে।
কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে চ্যানেলগুলো?
-কিডস অ্যানিমেশন চ্যানেল: এডসেন্স আয় প্রায় শূন্য হয়ে যাবে।
-ফ্যামিলি ভ্লগার্স: শিশুকে নিয়ে ভিডিও করতে চাইলে চ্যানেলকে 'মেড ফর কিডস' ট্যাগ করতে হবে, যার মানে এড রেভেনিউ কমে যাওয়া।
ইউটিউবের যুক্তি: "শিশুদের প্রাইভেসি ও সেফটি নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য।" কিন্তু ক্রিয়েটররা বলছেন, "আমাদের সন্তানেরা তো ভিডিও বানাতে পছন্দ করে! এভাবে আয় বন্ধ করে দেওয়া কি সমাধান?"
৫. স্ট্রাইক পলিসিতে রিমর্স: তিন স্ট্রাইক নয়, এবার দুই স্ট্রাইকেই চ্যানেল বন্ধ!
ইউটিউবের স্ট্রাইক সিস্টেম আগে ছিল রিল্যাক্সড। তিনটি কমিউনিটি গাইডলাইন ভায়োলেশন হলেই চ্যানেল বন্ধ হতো। নতুন নিয়মে দুই স্ট্রাইক পেলেই চ্যানেল ডিলিট হওয়ার ঝুঁকি! বিশেষ করে হেট স্পিচ, হারাসমেন্ট, বা ড্যাঞ্জারাস কনটেন্টের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে ইউটিউব।
কী করতে পারেন?
- প্রথম স্ট্রাইক পেলে ৯০ দিনের মধ্যে আপিল করুন।
- ভিডিও ডিলিট বা এডিট করে পুনরায় আপলোড করুন।
- স্ট্রাইকের ইতিহাস রিসেট হতে সময় লাগে ৯০ দিন।

ক্রিয়েটরদের ভুলের উদাহরণ:
- প্রাঙ্ক ভিডিও: কাউকে ভয় দেখানো বা বিব্রত করাকে এখন 'হারাসমেন্ট' ধরা হবে।
- মেমেস: কারো ছবি এডিট করে ব্যঙ্গাত্মক কনটেন্ট দিলে স্ট্রাইক হতে পারে।
৬. নতুন সুযোগ: ক্রিয়েটরদের জন্য ফান্ডিং ও মেম্বারশিপ টুলস।
শুধু খারাপ খবর নয়, ইউটিউব কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনও এনেছে। চ্যানেল সাবস্ক্রাইবাররা এখন সরাসরি ক্রিয়েটরদের ফাইনান্সিয়াল সাপোর্ট দিতে পারবেন নতুন টুলসের মাধ্যমে।
কী কী অপশন আসছে?
-সুপার থ্যাঙ্কস: ভিউয়াররা ভিডিও দেখার সময় ইমোজি কিনে দিতে পারবেন, যার আয় সরাসরি ক্রিয়েটরের অ্যাকাউন্টে যাবে।
-এক্সক্লুসিভ মেম্বারশিপ: সাবস্ক্রাইবাররা মাসিক ফি দিয়ে এক্সক্লুসিভ লাইভ স্ট্রিম, ইমোজি বা বেডজ পাবেন।
-ক্রাউডফান্ডিং প্রজেক্টস: নতুন গ্যাজেট কিনতে বা ট্যুরের জন্য ভিউয়ারদের কাছ থেকে তহবিল তুলতে পারবেন।
লোকাল ক্রিয়েটরদের প্রতিক্রিয়া: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অনেক ইউটিউবার বলছেন, "এটা আমাদের জন্য গেম-চেঞ্জার হতে পারে, কারণ এডসেন্সের আয় অনিয়মিত।"
৭. লাইভ স্ট্রিমিং নীতিমালা: রিয়েল টাইমে সেন্সরশিপ!
লাইভ স্ট্রিমের সময় ক্রিয়েটররা আগে যা-ই বলুন না কেন, এখন অটোমেটিক AI মডারেশন সিস্টেম কাজ করবে। কোনো বাজে মন্তব্য বা বেআইনি কনটেন্ট শনাক্ত হলে স্ট্রিমটি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
কেস উদাহরণ:
-গেমিং স্ট্রিমে গালাগালি: AI স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিটেক্ট করে স্ট্রিম বন্ধ করবে।
-লাইভ Sales পিচ: নকল প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন দিলে চ্যানেল সাসপেনশন।
টিপস: লাইভের আগে স্ক্রিপ্ট রেডি করুন, এবং মডারেটর টিমকে অ্যালার্ট রাখুন যেকোনো সমস্যা ঠিক করতে।

৮. ডেটা অ্যাক্সেস ও ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট।
ইউটিউব এখন ক্রিয়েটরদের তাদের ভিডিও পারফরম্যান্সের ডিটেইলড ডেটা দেবে। শুধু ভিউ কাউন্ট নয়, আপনি জানতে পারবেন—
- ভিডিওতে কতজন ইউজার স্কিপ করেছে এড।
- কোন দেশের ভিউয়াররা সবচেয়ে বেশি এনগেজড।
- কোন সেকেন্ডে ভিউয়াররা ভিডিও ছেড়ে দিয়েছে।
কীভাবে কাজে লাগাবেন?
- ভিউয়ার রিটেনশন রেট দেখে কনটেন্টের স্ট্রাকচার পরিবর্তন করুন।
- জনপ্রিয় জিও-লোকেশনে টার্গেটেড ভিডিও বানান।
সবশেষে: এই নিয়ম মানলেই কি সাফল্য আসবে?
ইউটিউবের নতুন নীতিমালা অনেককে ভীত করলেও, এগুলো আসলে প্ল্যাটফর্মটিকে আরো সেফ ও ক্রিয়েটর-ফ্রেন্ডলি করতে সাহায্য করবে। যারা আগে থেকে নিয়ম মেনে কনটেন্ট বানিয়েছেন, তাদের জন্য নতুন সুযোগের দুয়ার খুলছে। আর যারা শর্টকাট পথে ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করছেন, তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়বে। আপনার কনটেন্ট যদি অরিজিনাল, এডুকেশনাল এবং অডিয়েন্স-ফোকাসড হয়, তাহলে এই পরিবর্তন আপনার জয়কে ত্বরান্বিত করবে। তাই প্যানিক না করে, নিয়মগুলোকে আপনার স্ট্র্যাটেজির অংশ বানান। আর হ্যাঁ, ইউটিউবের সাথে আপডেট থাকুন—কারণ আগামী পরিবর্তন হয়তো আপনার দোরগোড়ায়ই!
দ্রষ্টব্য: নিয়মগুলো প্রযোজ্য হতে পারে আপনার দেশের লোকাল লজ অনুসারে। তাই ইউটিউব ক্রিয়েটর সাপোর্ট বা লিগ্যাল এক্সপার্টের পরামর্শ নিন।